আর্ট গ্যালারী ও শিলিগুড়ি
শহরে এই পর্যন্ত ব্যক্তিগত উদ্যোগে যে সকল আর্ট গ্যালারী গুলি তৈর হয়েছিল, সেগুলো প্রত্যেকটি অল্প সময়ের মধ্যেই বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
শিলিগুড়িতে প্রথম ব্যক্তিগত উদ্যোগে স্থানীয় ২৭ বছর বয়সী চিত্রশিল্পী দীপায়ন ঘোষ ★ GALLERY 360°'★ নামে 2006-2008 সাল পর্যন্ত একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে আর্ট গ্যালারী তৈরি করেছিল।
এই গ্যালারিতে যে সকল গুরুত্বপূর্ণ চিত্র-প্রদর্শনী আয়োজিত হয়েছিল যেমন, কলকাতার 'বেহালা ফাইন আর্টস সোসাইটি' এবং গ্যালারি ৩৬০°যৌথ উদ্যোগে দশ দিনব্যাপী একটি চিত্র প্রদর্শনী, গ্যালারী পক্ষ থেকে আয়োজিত শিলিগুড়ি এবং জলপাইগুড়ি চিত্রশিল্পীদের যৌথ প্রদর্শনী, গ্যালারি পক্ষ থেকে আয়োজিত শিলিগুড়ির চিত্রশিল্পী নিতাই বণিকের একক চিত্র প্রদর্শনী, গ্যালারির পক্ষ থেকে আয়োজিত চিত্রশিল্পী দীপায়ন ঘোষ এবং ভাস্করশিল্পী সুশান্ত পালের ইনস্টলেশন এবং দীপায়ন ঘোষের একক প্রদর্শনী 'Untitled Bed' (শিরোনামহীন বিছানা) অন্যতম। সুদূর দিল্লি থেকে এসে একমাত্র চিত্রশিল্পী কৃশানু সেনগুপ্ত তার একক চিত্রপ্রদর্শনী আয়োজন করেছিল গ্যালারি ভাড়া নিয়ে। এছাড়া গ্যালারি নিজের কর্ম পরিধি সাংস্কৃতিক জগতের সমস্ত অংশের ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য সাহিত্য ও শিল্পের মেলবন্ধন ঘটিয়ে একাধিক অনুষ্ঠান আয়োজন করেছিল। এই গ্যালারিটির মাধ্যমে প্রথম শিলিগুড়ি বাসি দেখতে পেয়েছে ভিডিও ইনস্টলেশন আর্ট।
প্রয়াত শিল্প ও সাহিত্য জগতের স্বনামধন্য বেশ কিছু ব্যক্তিত্ব যারা এই গ্যালারিতে এসেছিলেন যেমন, শিলিগুড়ি কলেজের অধ্যক্ষ শ্রী হরেন ঘোষ ,শিলিগুড়ির প্রখ্যাত সাহিত্যিক শ্রী সমর চক্রবর্তী, উত্তরবঙ্গের বিশিষ্ট কবি শ্রী পুণ্যশ্লোক দাশগুপ্ত, শিলিগুড়ির ভাস্কর্য শিল্পী প্রকাশ কান্তি দে।
বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে অতীতের এই গ্যালারিটি বন্ধ হওয়ার পেছনে কিছু কারণ অন্বেষণ করা যাক ঃ
১. সময় হিসেবে উন্নত প্রযুক্তির অভাব এবং দুর্বল যোগাযোগ ব্যবস্থা যেমন, ব্যাপক মাত্রায় অপ্রচলিত মোবাইল ফোন ও সহজলভ্য সোশ্যাল মিডিয়ার অনুপস্থিতি, দুর্বল প্রচার ব্যবস্থায় হাতের কর গুনতি কিছু সংবাদপত্র।
২. শিল্পকলা সংগ্রহের প্রতি মানুষের কখনো উদাসীন বা কখনো নেতিবাচক চিন্তাভাবনা।
৩. ধারাবাহিকভাবে ভালো মানের শিল্প-প্রদর্শনী না হওয়া অর্থাৎ স্থানীয়ভাবে শিল্পীদের শিল্পকর্ম উৎপাদনের অভাব আর, এর কারণ হলো শিল্পীরা যখন অতি সহজে হাতে খড়ি শিক্ষায় কোন যোগ্যতার মাপকাঠি ছাড়াই শিল্প উৎপাদনে না গিয়ে, শিল্প-শিক্ষার ব্যবসায় নিজেকে পটু করতে তৎপর আর এই ব্যবসায় প্রতিমাসে নির্দিষ্ট পরিমাণের অর্থ-রোজগার স্থির সুতরাং তারা ছবি বিক্রির ভরসায় কেন থাকবেন আর এই কারনেই শিল্পীদের গ্যালারি ভাড়া নেওয়ার আর কোন প্রয়োজন থাকে না।
৪. স্থানীয় শিল্পীদের উদাসীন ও ঈর্ষাপরায়ণ তুলনা-মুলক দৃষ্টিভঙ্গি। তারা নিজেরা স্থানীয় হয়েও স্থানীয় প্রতিভাদের হেয় বা হীণ আচরণের সাথে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করে যাতে তাদের প্রভুত্বের কোন প্রতিদ্বন্দ্বী না জন্মায়। এবং কৌশলের সঙ্গে পরোক্ষভাবে সাধারণ শিল্প শিক্ষানবিশদের কাছে শহরে অবস্থিত একমাত্র এই আর্ট গ্যালারীটির অপপ্রচার অর্থাৎ গুরুত্ব কমানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করা। ঠিক একই কারণে এই শহরে আজ পর্যন্ত শিল্পীদের কোন শক্তিশালী সংগঠন গড়ে ওঠেনি বা বলা যেতে পারে গড়ে উঠতে দেওয়া হয়নি। আর এই অদ্ভুত শিল্পকলার রাজনীতি ও ষড়যন্ত্রের শিকার হতে হলো গ্যালারীটিকে।
৫. গ্যালারি তৈরীর নির্বাচনের স্থান, এই গ্যালারিটি যদি শহরের জনবহুল এলাকা বিশেষ করে কোন বড় রাস্তা, মার্কেটপ্লেস কিংবা শপিংমলে হতো তাহলে দর্শক বা ক্রেতার জন্য কোন অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে হতো না। দুঃখের বিষয় সেই সময় শিলিগুড়িতে এত ঘনবসতি এবং শপিংমল ও ছিল না।
৬. গ্যালারির ব্যবসা চালাতে যে পরিকল্পনা, পুঁজি,ধৈর্য,আর্ট কালেক্টরদের সঙ্গে যে সম্পর্ক স্থাপন প্রয়োজন ছিল, তা সে সময় গ্যালারির মালিক তৈরি করতে পারেননি। যা এই ব্যবসার অন্যতম মূল চাবিকাঠি।
৭. পূর্ব অভিজ্ঞতা হীন হয়ে এই ব্যবসায় নামা গ্যালারি বন্ধ হওয়ার অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ।
৯. গ্যালারির নিজস্ব রেজিস্ট্রেশন, নিজস্ব শিল্পী, কিউরেটর,মার্কেটিং এক্সপার্ট, অ্যাডভাইজারি কমিটি, ম্যানেজমেন্ট টিম, পেট্রন বা তহবিল সংগ্রহকারী এবং পরিশেষে বিজ্ঞাপন না থাকা গ্যালারিটি বন্ধের অপর একটি মূল কারণ ।
১০. পরবর্তী পর্যায়ে পুজির সংকট এবং পরিশেষে গ্যালারি বন্ধ।
তবে প্রশ্ন থেকে গেল ইতিহাস কিভাবে এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা মনে রাখবে।
No comments:
Post a Comment