Tuesday, July 27, 2021

১৯১৮ সালের 'স্প্যানিশ ফ্লু মহামারী' কবলে বিখ্যাত চিত্রশিল্পী ও তাঁদের শিল্পকলা: চিত্রশিল্পী এগন শিয়েল ( Egon Schiele) : পর্ব - ৩, দীপায়ন ঘোষ

 



১৯১৮ সালের 'স্প্যানিশ ফ্লু মহামারী' কবলে বিখ্যাত চিত্রশিল্পী ও তাঁদের শিল্পকলা: চিত্রশিল্পী এগন শিয়েল(Egon Schiele) :  

পর্ব - ৩,  দীপায়ন ঘোষ  


চিত্রশিল্পী এগন শিয়েল ( Egon Schiele) : 


       এগন শিয়েলের জন্ম ১২ই জুন ১৮৯০ অস্ট্রিয়া এবং তাঁর মৃত্যু ৩১শে অক্টোবর ১৯১৮, সে সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র 28 বছর, তাঁর মৃত্যুর কারণ ছিল ১৯১৮ সালের 'স্প্যানিশ ফ্লু' মহামারী। এগন শিয়েল ছিলেন, একজন মূলত অভিব্যক্তিবাদী চিত্রশিল্পী অর্থাৎ Expressionist painter। অবশ্য তাঁর সম্পূর্ণ জীবন কালে এক্সপ্রেশনিজম এর পাশাপাশি Vienna Secession, art Nouveau, Symbolism, Modernism শিল্প আন্দোলন গুলি লক্ষ্য করা গিয়েছিল। তিনি ছিলেন ভিনসেন্ট ভ্যান গগ, এডওয়ার্ড মুঞ্চ, গুস্তাভ ক্লিম্ট ( Vincent van Gogh, Edward Munch, Gustav Klimt) এর মত প্রমুখ বিখ্যাত চিত্রশিল্পীদের সমকালীন। এগন শিয়েলকে বলা হতো Modern Figurative painting এর পথপ্রদর্শক সহ তাঁর পরিচিতি ছিল একজন এরোটিক বা প্রেমমূলক এবং গভীর মনস্তাত্ত্বিক প্রতিকৃতি চিত্রশিল্পী ( Erotic and deep psychological portrait painter)। অল্প রং এবং গাঢ় রেখায় ছবিকে আবেদনমূলক তৈরি করা ছিল তাঁর কাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। বিবস্ত্র বা কখনো অর্ধনগ্ন মানব শরীর সরাসরি দর্শকের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রেখেছে যা অনেকাংশেই সকলের কাছে অস্বাভাবিক এবং অস্বস্তির কারণ হতো। ১৯১২ সালে তাঁকে ২১ দিন কারাগারে কাঁটাতে হয়েছিল, তাঁর বেশ কিছু শিল্পকর্মকে পর্নোগ্রাফি বলে সমালোচকেরা অভিযোগ করেছিল। শিল্পী একজন প্রটেস্ট্যান্ট ধর্মাবলম্বী মধ্যবর্তী পরিবার থেকে উঠে এলে ও তাঁর কোনো প্রকার শিল্পকর্মের মধ্যে এই মতাদর্শের ছাপ প্রত্যক্ষ করা যায়নি বরং তাঁর ছবিগুলির মধ্যে নারী, নগ্নতা, যৌনতা এবং তার পাশাপাশি মৃত্যু, অসুস্থতা, জীর্ণ, ভঙ্গুর ও অস্বাভাবিক শারীরিক অঙ্গভঙ্গিমা ছবির গঠনে এক অদ্ভুত বৈষম্যতা প্রদর্শন করাত।

মৃত্যুর পূর্বে শিল্পী কয়েকটি কাজ করে গিয়েছিলেন, আমাদের এই আলোচনায় আমি এখানে তাঁর দুটি ড্রইং এবং একটি পেইন্টিং বিষয় নিয়ে আলোচনা করব। 

প্রথমে আসি তাঁর শেষ পেইন্টিংটির প্রসঙ্গে :  ছবির শিরোনাম 'পরিবার'(The family) যার 


আয়তন ৬০"x ৬৪"ইঞ্চি ( 152.5 cms X 162.5 cms)। ছবিটি তৈরি করা হয়েছিল তেলরঙে (Oil Painting) এবং বর্তমানে ছবিটির রয়েছে দি ন্যাশনাল গ্যালারি লন্ডন( The National Gallery London)। দুঃখের বিষয় হল শিল্পী অনেকাংশেই ছবিটি সম্পূর্ণ করে যেতে পারেননি, ছবিটির শেষ  করার আগেই তিনি 'স্প্যানিশ ফ্লু' আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিলেন। 

আসুন ছবিটির বিস্তারিত আলোচনায় আসা যাক।

ছবিটির শিরোনাম স্পষ্ট করে দেয় যে এটি একটি পরিবারের ছবি শিল্পী তাঁর নিজের পরিবারকে কল্পনা করেছেন এভাবে। তবে ছবিটির কম্পোজিশন বা গঠন যথেষ্ট জটিল। ছবিটির তিনটি প্রধান বিষয়ের দিকে সবার আগে দর্শকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, একজন পুরুষ যা শিল্পী নিজেই তার নিচে রয়েছেন তাঁর স্ত্রী এডিথ এবং নিচে তাঁদের দুজনের অনাগত শিশু যে পৃথিবীর আলো কখনো আর দেখিনি। 

শিল্পীর নিজস্ব রচনাশৈলীর বিপরীতে যা কিনা অস্বাভাবিক কেবল অঙ্গভঙ্গিমা আবেদনমূলক অবস্থার অভিব্যক্তি, মানব শরীরের আবির্ভাব চিত্র বর্ণনা করার মূল ভাবধারা তাঁকে অতিক্রম করে যায়। ছবিটির মূল বা প্রধান চরিত্র পুরুষ অত্যন্ত স্থির শান্তভাব সম্পন্ন। অনেক বিশেষজ্ঞদের মতে, শিল্পী তাঁর প্রতীক্ষিত ঘটনাগুলির করুন মোর সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন এই ছবিটির রচনার মধ্যে দিয়ে। ছবিটির উপরের অংশে প্রধান মূল চরিত্র পুরুষটি অর্থাৎ চিত্রশিল্পী নিজেই নিঃশব্দে এক অস্বাভাবিক অঙ্গভঙ্গিমায় হাঁটু মুড়ে বেশ শান্ত চেহারায় বসে আছেন। এই মুল চরিত্রটি চিরাচরিত কোনো অভিব্যক্তির উদ্বেগ প্রকাশ করছে না বরং এর উল্টোটা তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে তাঁর কাজ সম্পূর্ণ করে আত্মবিশ্বাসের সাথে কোন ফল ফলাফলের অপেক্ষায় রয়েছেন। তাঁর গায়ের রং হলুদ এবং কমলা আর গাঢ় লালের আন্ডারলাইন (Underline) ব্যবহার করা হয়েছে।

চরিত্রটি হাঁটু মুড়ে এমন ভাবে বসেছে যে তাঁর বাঁ হাত বাঁ পায়ের হাটুর ওপর রাখা এবং ডান হাতটি কনুই মুরে বাঁ হাতের হাতের কাঁধের কাছে আনা।

ডান হাত ও তাঁর আঙ্গুল দেখে মনে হচ্ছে শিল্পী তাঁর কাঁধে আঁচর কাটছেন। অনেকটা আমরা কোন জিনিসকে মন দিয়ে লক্ষ করার সময় গুরুত্বহীনভাবে শারীরিক কোনো অ্যাক্টিভিটি করে থাকি। এই মূল পুরুষ চরিত্রটির অর্থাৎ চিত্রশিল্পীর ঠিক নিচে এবং ছবিটির একেবারে কেন্দ্রে একটি সুন্দর মহিলাকে আঁকা হয়েছে। এটি হলো তাঁর স্ত্রী  এডিথ এবং পুরুষ চরিত্রটির মত এই মহিলাটি অর্ধনগ্ন, অনাবৃত তাঁর বুক অথচ তাঁর পায়ের এবং হাতের আঙ্গুলগুল সব ঢাকা মোটা কাপড়ের ভেতর। মহিলাটির গায়ের রঙ গোলাপী, কমলা চেহারায় উদাস বা কোন আবেগের অভিব্যক্তি নেই  

আর মনে হচ্ছে তাঁর সম্পূর্ণ নির্ভরশীলতা স্ব-ইচ্ছায় পুরুষ চরিত্রটির উপর সমর্পিত। তবে তাঁর চেহারায় কোন উজ্জ্বাল্য ভাব নেই, ম্লান এবং সবটাই অদৃষ্টের ওপর ফেলে রাখা। এই কারণেই হয়তো শিল্পী এই মহিলার হাত ও পায়ের দৃশ্যত অবস্থান দর্শকের সামনে সুস্পষ্ট করে তুলে ধরেননি। পুরুষ চরিত্রটির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে শিল্পী মহিলাটিকে ও অনেকটাই একইভাবে হাঁটু মুড়ে বসা অবস্থায় এঁকেছেন। ছবিটিতে মূখ্য এই দুটি চরিত্রের পর যদি কোথাও চোখ যায় তা হল মহিলাটির ঠিক নিচে তাঁর ডান পা ঘেঁষে অবস্থান করছে একটি শিশু। শিশুটি নিষ্পলকে তাকিয়ে রয়েছে ছবিটির বাঁদিকের শূন্যতায় আর তাঁর হাত দুটো দিয়ে একটি নরম বালিশ কে জাপটে ধরে রয়েছে। স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে এই বালিশটি শিশুর খুব প্রিয় বস্তু। যদিও শিশুটির সর্বাঙ্গ গরম পোশাক কিংবা কম্বলে ঢাকা শুধু তাঁর উজ্জ্বল কমল মুখ বেরিয়ে রয়েছে। শিশুটির অবস্থান এমন যেন তাঁর মা অর্থাৎ সেই মহিলা দুপাশ থেকে পা দিয়ে হাঁটু মুড়ে বসে শিশুটিকে নিরাপদ রাখার চেষ্টা করছে। মহিলাটির এইরূপ অবস্থান একটু অস্বস্তিকর মনে হতে পারে। দৃশ্যটা অনেকটা যেন মা সন্তানের জন্ম দিচ্ছেন এমন। আসল শিল্পী যখন ছবিটি তৈরি করছিলেন তখন তাঁর স্ত্রী ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন, এক্ষেত্রে শিল্পী তার সম্পূর্ণ পরিবারের এক কল্পনাকে এক বাস্তব রূপ দিচ্ছিলেন। ছবিটিতে এই তিনটি মূল চরিত্রের অভিব্যক্তি একে অপরের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা কিন্তু এই তিনজনের উৎস এবং অবস্থান এক এবং সেই পটভূমি অত্যন্ত অস্পষ্ট তবে অনুমান করে নেওয়া যেতে পারে যে পরিবারটি সোফায় বসে আছে বা কম্বল কিংবা চাদরের অনেক গোছের উপর বসে। সেখানে গাঢ় বাদামি, লাল এবং ধূসর রং এর পটভূমি হালকা সবুজ এবং নীলচে অস্পষ্ট উপাদান গুলিতে মিশে রয়েছে। 'The Family' ছবিটি সমগ্র মানবজাতির এক বুনিয়াদ পরিবার প্রথার যুক্তিভিত্তির সাক্ষ্য বহন করে। 

সম্পূর্ণ পরিবারের এই ছবি কেবল ছবিতেই সীমাবদ্ধ থেকে গেল কারণ চিত্রশিল্পীর ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী এডিথ 'স্প্যানিশ ফ্লু'তে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিলেন এবং তাঁর তিনদিন পর চিত্রশিল্পী নিজেও মারা গিয়েছিলেন। 



শিল্পী তার স্ত্রীর মৃত্যু শয্যায় একটি ড্রয়িং তৈরি করেছিলেন। শিল্পী ড্রইং টির নাম দিয়েছিলেন 


'Edith Schiele on her deathbed', 1918, Chalk on paper. ছবিটি রয়েছে Leopold Museum, Vienna, Austria.

১৯১৮ সালের 'স্প্যানিশ ফ্লু' মহামারীতে তাঁর মৃত্যুর আগে বিখ্যাত চিত্রশিল্পী এবং তাঁর পথপ্রদর্শক বা গুরু বলে কিছু ভুল হবে না, চিত্রশিল্পী গুস্তাভ ক্লিম্টের (Gustav Klimt) এই মহামারিতে জীবন অবসান ঘটে এবং ক্লিম্টের মৃত্যুর ঠিক একদিন আগে তাঁর মৃত্যু শয্যার পাশে বসে এগন শিয়েল তাঁর গুরুর কিছু আত্মপ্রতিকৃতি ড্রইং করেছিলেন। 


এই ড্রয়িংটির নাম ছিল 'Gustav Klimt on his deathbed, February, 1918,। মৃত্যুর সময় শিল্পীর বয়স হয়েছিল ৫৫ বছর। শীতের শুরুতে ক্লিম্টের একটি স্ট্রোক হয়েছিল যা তাঁকে আংশিকভাবে পঙ্গু অর্থাৎ প্যারালাইসিস (Paralysis) করে দিয়েছিল। প্রথমে তাঁকে একটি স্থানীয় স্যানেটোরিয়ামে (Sanatorium) আনা হয় এবং পরে তাঁর  স্থিতিশীল অবস্থা হলে তাঁকে ভিয়েনার একটি বড় হাসপাতালে পাঠানো হয় কিন্তু মহামারীর কবলে পরায় তাঁর অবস্থার দ্রুত অবনতি হয় এবং তাঁর মৃত্যু হয়।


এগন শিয়েল ক্লিম্টের মৃত্যুশয্যায় বিভিন্ন কোণ থেকে ড্রইং গুলি করেছিলেন এবং প্রত্যেকটিতেই তাঁর চোখ বন্ধ ছিল আর মুখ আংশিক খোলা। মুখে ছিল অসংখ্য ভারী রেখা এবং ছায়াযুক্ত রেখাগুলি একদম স্থির এমনটা নয় কিন্তু এই গুলি ছিল মৃত্যুর এক অসাড় চিত্র।  ক্লিম্টের চুলের কিছু

রেখা তাঁর মুখের গাঢ় জেদি রেখার সাথে মিল ছিল  না আর সেইসঙ্গে চোয়ালের রেখাও তাঁর তীক্ষ্ণ কান, মুখের ভাব ব্যক্ত করার ক্ষেত্রে একটা অস্থিরতা তৈরি করে। এগন শিয়েলর এই ড্রইংগুলির অভিব্যক্তির সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল ক্লিম্টের প্রকৃত ডেথ মাস্কটির (Death Mask) অভিব্যক্তি। তাতে তাঁর মুখ শান্ত, অস্থির এক প্রশান্তির কথা বলে।

End.

১৯১৮ সালের 'স্প্যানিশ ফ্লু মহামারী' কবলে বিখ্যাত চিত্রশিল্পী ও তাঁদের শিল্পকলা: চিত্রশিল্পী এডওয়ার্ড মঞ্চ ( Edvard munch) : পর্ব - ২, দীপায়ন ঘোষ


 ১৯১৮ সালের 'স্প্যানিশ ফ্লু মহামারী' কবলে বিখ্যাত চিত্রশিল্পী ও তাঁদের শিল্পকলা:

 চিত্রশিল্পী এডওয়ার্ড মঞ্চ ( Edvard munch) :  

পর্ব - ২,  দীপায়ন ঘোষ  


এডওয়ার্ড এর জন্ম ১২ই ডিসেম্বর ১৮৬৩, অ্যাডালসব্রুক, নরওয়ে এবং মৃত্যু ২৩শে জানুয়ারি ১৯৪৪, অসলো, নরওয়ে এডওয়ার্ড মঞ্চ ছিলেন একজন অভিব্যক্তিবাদ চিত্রশিল্পী অর্থাৎ Expressionism painter তাঁর কাজের মধ্যে পাওয়া যায় তাঁর ব্যক্তিগত শোকাবহ ঘটনা, বিষন্নতা, বিমর্ষ গভীর আবেগের অনুবাদ, বিশৃংখল এক রহস্য দিয়ে গড়া বিভিন্ন মানুষের অভিব্যক্তি তাঁর সবচাইতে বিখ্যাত এবং জনপ্রিয় বললে ভুল হবে না 'The Scream' নামক ছবিটি, বিশ্ব শিল্পকলার ইতিহাসে একটি অমূল্যবান সম্পদ



                                                                              The Scream Edvard Munch

 এই কাজটির সমতুল্য লিওনার্দো দা ভিঞ্চির 'মোনালিসা', ভিনসেন্ট ভ্যান গগের 'দি স্টারি নাইট' এবং পাবলো পিকাসোর আঁকা 'গোর্নিকা' ছবিগুলি এবার আসি তাঁর এমন দুটি ছবির প্রসঙ্গে যার নাম করন থেকেই স্পষ্ট হয়ে যায় বিশ্বজুড়ে 'স্প্যানিশ ফ্লু' মহামারীর হালহকিকত


Edvard Munch (1863 1944) in his studio with canvas, in Ekely, at Skoyen, Oslo Norway, in 1943 (last photograph taken of him).

১৯১৯ সালে চিত্রশিল্পী 'স্প্যানিশ ফ্লু' মহামারীর কবলে পড়েন, সুস্বাস্থ্যের একজন ৫৬ বছর বয়সী ব্যক্তি হিসেবে যাত্রায় তিনি বেঁচে ওঠে কিন্তু তাঁর এই অভিজ্ঞতাটি তিনি দুটি আত্মপ্রতিকৃতি ছবির মধ্যে তুলে ধরেন স্প্যানিশ ফ্লু আক্রান্ত হয়ে তিনি যে দুটি ছবি এঁকেছিলেন তাঁর একটি শিরোনাম ছিল 'self-portrait with the Spanish flu', ১৯১৯ সালে, তেলরঙে ক্যানভাসের উপর আঁকা, যার মাপ ৫৯" ইঞ্চি x ৫২" ইঞ্চি এবং দ্বিতীয় ছবিটির শিরোনাম ছিল "Self-portrait after the Spanish flu", ১৯১৯- ১৯২০ সালে,তেলরঙে ক্যানভাসের উপর আঁকা, যার মাপ ২৩" ইঞ্চি x ২৯" ইঞ্চি এই দুটি ছবি বর্তমানে National Gallery Munch Museum Oslo Norway তে রয়েছে

 ছবি দুটি বিষয়ে আলোচনায় যাওয়ার আগে আসুন চিত্রশিল্পীর ব্যক্তিগত জীবনের দু-চার কথা জেনেনি |শিল্পী তাঁর পাঁচ ভাই বোনের মধ্যে দ্বিতীয় সন্তান ছিলেন,১৮৬৪ সালে তাঁর পরিবারের সকলরে সাথে ওসলো শহরে জন্মস্থান ছেড়ে চিরতরের জন্য চলে আসেন এখানে এসে তাঁর মা মারা যান চার বছর যক্ষা (Tuberculosis) রোগে আক্রান্ত হয়ে এবং এর সাথেই শুরু হয় তাঁর পরিবারে একের পর এক শোক যাত্রা এরপর তাঁর বোন সোফি ১৮৭৭ সালে যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান,তখন তাঁর বোনের ১৪ বছর বয়স ছিল



পরবর্তী সময়ে শিল্পী 'The Sick Child'  নামক একটি ছবি এঁকেছিলেন (১৮৮৫-১৮৮৬ সালে) তাঁর বোনের এই অসুস্থতার ওপর তাঁর আরও এক বোন জীবনের বেশিরভাগ অবস্থা মানসিক অবসাদ নিয়ে কাটিয়ে দিয়েছিল এরপর তাঁর একমাত্র ভাই ৩০ বছর বয়সে এই 'স্প্যানিশ ফ্লু' এর কারণে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান চিত্রশিল্পী, এডওয়ার্ড মঞ্চ তাঁর ডায়েরিতে লিখেছেন, "Illness, insanity and death where the black angels that kept watch over my cradle and accompanied all my life ".অর্থাৎ "অসুস্থতা, মানসিক উন্মাদনা এবং মৃত্যুর কালো অন্ধকারের স্বর্গদূতরা আমার শৈশবাবস্থাকে নজরবন্দি করেছিল এবং আমার সাথে থেকে গিয়েছিল"

আসুন এবার শিল্পীর মূল ছবি দুটিকে নিয়ে আলোচনা করি: প্রথমে তাঁর প্রথম ছবিটি 'স্পেনীয় ফ্লুতে স্ব-প্রতিকৃতি' ('Self-portrait with the Spanish flu') 
ছবিটিতে, শিল্পী বিচ্ছিন্ন এবং একা নিজের ঘরে একটি উইকার চেয়ারে ভারী অসুস্থ পোশাকে এবং কম্বল জড়িয়ে বসে আছেন ভারী পোশাকে থাকা সত্ত্বেও স্পষ্টতই তাঁর ভগ্ন শারীরিক অবস্থা বোঝা যাচ্ছে তাঁর চেহারায় কোন উজ্জ্বলতা নেই, বিবর্ণ, ফ্যাকাশে এবং অনুমান করা হয়েছিল তাঁর জন্ডিস হয়েছিল তবে বিষয়ে কোনো ভরসা যোগ্য তথ্য পাওয়া যায়নি তাঁর চুল হালকা এবং পাতলা দেখাচ্ছিলো এবং এমন পলকহীন চোখে দর্শকের দিকে শিল্পী তাকিয়ে আছেন যেন দর্শককে তিনি তাঁর কষ্টের কথা, অসুবিধার কথা, অসুস্থতার কথা জানান দিচ্ছেন তাঁর মুখ খোলা বা হা করা হয়তো, রোগের কারণে তাঁর স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাসে অসুবিধা হচ্ছে কিংবা অসুস্থতার কারণে অস্থিরতা বা প্রলাপ বলেছেন তিনি একটি ঘরে সম্পূর্ণ একা, আইসোলেশনে রয়েছেন যদিও এই নিঃসঙ্গতা তাঁর জীবনে ছবির একটি বৈশিষ্ট্য ভাবতেও অবাক লাগে এত অসুস্থতার মধ্যেও তিনি এই ছবিটি তৈরি করেছিলেন। আসুন এবার ছবিটির বাকি অংশগুলির দিকে একটু চোখ ফেরাই যেমন, দেওয়াল তাঁর রঙ, শিল্পী চেয়ারের পাশে বা পেছনে রাখা বিছানার এক অংশ, ঘরটির মেঝে ইত্যাদিতে বেশ উজ্জ্বল রঙের ব্যবহার যা কিনা একটি ইতিবাচক অথবা আশাবাদী দিকে তুলে ধরছে আর ওই উজ্জল্যতা শিল্পীর চেহারায় যথেষ্ট পরিমাণে প্রতিফলিত হচ্ছে মহামারীর উদ্বিগ্ন নিরাশাকে খুব সহজেই ছবির এই নিজস্ব আলো নষ্ট করে দিচ্ছে তবে এটা বলা খুব কঠিন যে, এই রঙের ব্যবহার শিল্পীর কতটা কল্পনার বা কতটা বাস্তবের সাথে জড়িত ঠিক একইভাবে ছবিতে ঘরের মেঝেটি যথেষ্ট রঙিন, সম্ভবত এই রং কোনো রঙিন গালিচারচেয়ার এর পেছনের দিকে সম্ভবত একটি দরজা খোলা অবস্থায় তবে দরজাটি কোন বাইরে যাবার নয় বরং অন্য একটি ঘরের, যেখানে তুলনামূলকভাবে আলো অনেক কম যা কিনা শিল্পীর মনের গভীর অবসাদকে রহস্যজনকভাবে ব্যক্ত করে
দ্বিতীয় ছবিটির নাম 'স্প্যানিশ ফ্লুর পরে স্ব- প্রতিকৃতি'( 'Self-portrait after the Spanish flu'),নামকরণ থেকে আবারো স্পষ্ট হয়ে যায় শিল্পী সুস্থতার দিকে ক্রমশ এগিয়ে চলেছেন এই 'স্প্যানিশ ফ্লু' তাঁর শারীরিক যতটা ক্ষতি করার করে দিয়েছে তাঁর এই দ্বিতীয় ছবিটিতে শিল্পী উঠে দাঁড়িয়েছেন, এই সময়ে তাঁর ছবিতে আর কোন উকার চেয়ার  নেই ছবিটিতে এমন ভাবে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন কিছুটা ঝুঁকে মুখটা এগিয়ে মনে হচ্ছে তিনি কোন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চেহারা পর্যবেক্ষণ করছেন,এই অসুস্থতার মুখে বা চেহারায় কিরূপ প্রভাব ফেলেছে মজার বিষয় হলো ছবির কম্পোজিশন বা গঠন এমনই যে শিল্পী আয়নায় না তাকিয়ে সরাসরি দর্শকের চেহারায় তাঁর অবস্থার প্রতিফলন দেখতে চাইছেন, তাঁর এমনভাবে ঝুকে দাঁড়ানো স্পষ্ট করছে শারীরিক দুর্বলতা কাটেনি, তাঁর মুখের ভাব এখনো ক্লান্তির আর বিষন্নতায় ভরা চোখ, যার রং গাঢ়, মুখে রয়েছে অনেক ভাঁজ তবে আগের ছবির মত ফ্যাকাশে বা বিবর্ন নয় উজ্জ্বল রং এর ব্যবহার তাঁর চেহারায় অসুস্থতার অবশিষ্ট অংশগুলিকে একপ্রকার অস্বীকার করে তাঁর ডুবে যাওয়া ভারী চোখ দুটো এখন স্পষ্ট উজ্জ্বল, গাঢ় দৃঢ়ভাবে দৃষ্টি সুনিশ্চিত করছে তাঁর মুখের ঘন দাড়ি বড় বড় চুল home Quarantine এবং isolation জীবনকে ইঙ্গিত করছে তাঁর ঘরটি আগের ছবির মতো উজ্জ্বল আলোয় ভরে গিয়েছে গালিচার রং এবং টেবিলের বইগুলো স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসার সূচনা করে দিচ্ছে তাঁর পোশাক বদলে ফরমাল পোশাক হয়েছে, হয়তো তিনি তাঁর সুস্থতার ভাবকে পুষ্ট করতেই এই পোশাক কিংবা 
শিল্পীকে নিজের কোন কাজের জন্য বাইরে যেতে হবে
 


প্রসঙ্গত শিল্পীর 'অভ্যন্তরীণ অশান্তিতে স্বপ্রতিকৃতি'(Self-portrait in inner turmoil) শীর্ষক ১৯২০ সালের একটি ছবিতে নিজেকে নিদ্রাহীন এবং উত্তেজিত দেখায় তাঁর নিদ্রাহীনতা নিয়ে তিনি নিকট বন্ধুদেরকে অভিযোগ করেছিলেন এবং তাঁর এই অবস্থার জন্য তিনি পূর্বের 'স্প্যানিশ ফ্লু' কে দায়ী করেছিলেন


 To be continued...

 


 

"Shadow World" Curated by GHOSH at T-93 Art Gallery Kolkata

T-93 Art Gallery in Kolkata is set to host Shadow World, a solo exhibition by acclaimed artist Sabyasachi Mullick, from December 1 to 6, 202...