১৯১৮ সালের 'স্প্যানিশ ফ্লু মহামারী' কবলে বিখ্যাত চিত্রশিল্পী ও তাঁদের শিল্পকলা: চিত্রশিল্পী এগন শিয়েল(Egon Schiele) :
পর্ব - ৩, দীপায়ন ঘোষ
চিত্রশিল্পী এগন শিয়েল ( Egon Schiele) :
এগন শিয়েলের জন্ম ১২ই জুন ১৮৯০ অস্ট্রিয়া এবং তাঁর মৃত্যু ৩১শে অক্টোবর ১৯১৮, সে সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র 28 বছর, তাঁর মৃত্যুর কারণ ছিল ১৯১৮ সালের 'স্প্যানিশ ফ্লু' মহামারী। এগন শিয়েল ছিলেন, একজন মূলত অভিব্যক্তিবাদী চিত্রশিল্পী অর্থাৎ Expressionist painter। অবশ্য তাঁর সম্পূর্ণ জীবন কালে এক্সপ্রেশনিজম এর পাশাপাশি Vienna Secession, art Nouveau, Symbolism, Modernism শিল্প আন্দোলন গুলি লক্ষ্য করা গিয়েছিল। তিনি ছিলেন ভিনসেন্ট ভ্যান গগ, এডওয়ার্ড মুঞ্চ, গুস্তাভ ক্লিম্ট ( Vincent van Gogh, Edward Munch, Gustav Klimt) এর মত প্রমুখ বিখ্যাত চিত্রশিল্পীদের সমকালীন। এগন শিয়েলকে বলা হতো Modern Figurative painting এর পথপ্রদর্শক সহ তাঁর পরিচিতি ছিল একজন এরোটিক বা প্রেমমূলক এবং গভীর মনস্তাত্ত্বিক প্রতিকৃতি চিত্রশিল্পী ( Erotic and deep psychological portrait painter)। অল্প রং এবং গাঢ় রেখায় ছবিকে আবেদনমূলক তৈরি করা ছিল তাঁর কাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। বিবস্ত্র বা কখনো অর্ধনগ্ন মানব শরীর সরাসরি দর্শকের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রেখেছে যা অনেকাংশেই সকলের কাছে অস্বাভাবিক এবং অস্বস্তির কারণ হতো। ১৯১২ সালে তাঁকে ২১ দিন কারাগারে কাঁটাতে হয়েছিল, তাঁর বেশ কিছু শিল্পকর্মকে পর্নোগ্রাফি বলে সমালোচকেরা অভিযোগ করেছিল। শিল্পী একজন প্রটেস্ট্যান্ট ধর্মাবলম্বী মধ্যবর্তী পরিবার থেকে উঠে এলে ও তাঁর কোনো প্রকার শিল্পকর্মের মধ্যে এই মতাদর্শের ছাপ প্রত্যক্ষ করা যায়নি বরং তাঁর ছবিগুলির মধ্যে নারী, নগ্নতা, যৌনতা এবং তার পাশাপাশি মৃত্যু, অসুস্থতা, জীর্ণ, ভঙ্গুর ও অস্বাভাবিক শারীরিক অঙ্গভঙ্গিমা ছবির গঠনে এক অদ্ভুত বৈষম্যতা প্রদর্শন করাত।
মৃত্যুর পূর্বে শিল্পী কয়েকটি কাজ করে গিয়েছিলেন, আমাদের এই আলোচনায় আমি এখানে তাঁর দুটি ড্রইং এবং একটি পেইন্টিং বিষয় নিয়ে আলোচনা করব।
প্রথমে আসি তাঁর শেষ পেইন্টিংটির প্রসঙ্গে : ছবির শিরোনাম 'পরিবার'(The family) যার
আয়তন ৬০"x ৬৪"ইঞ্চি ( 152.5 cms X 162.5 cms)। ছবিটি তৈরি করা হয়েছিল তেলরঙে (Oil Painting) এবং বর্তমানে ছবিটির রয়েছে দি ন্যাশনাল গ্যালারি লন্ডন( The National Gallery London)। দুঃখের বিষয় হল শিল্পী অনেকাংশেই ছবিটি সম্পূর্ণ করে যেতে পারেননি, ছবিটির শেষ করার আগেই তিনি 'স্প্যানিশ ফ্লু' আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিলেন।
আসুন ছবিটির বিস্তারিত আলোচনায় আসা যাক।
ছবিটির শিরোনাম স্পষ্ট করে দেয় যে এটি একটি পরিবারের ছবি শিল্পী তাঁর নিজের পরিবারকে কল্পনা করেছেন এভাবে। তবে ছবিটির কম্পোজিশন বা গঠন যথেষ্ট জটিল। ছবিটির তিনটি প্রধান বিষয়ের দিকে সবার আগে দর্শকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, একজন পুরুষ যা শিল্পী নিজেই তার নিচে রয়েছেন তাঁর স্ত্রী এডিথ এবং নিচে তাঁদের দুজনের অনাগত শিশু যে পৃথিবীর আলো কখনো আর দেখিনি।
শিল্পীর নিজস্ব রচনাশৈলীর বিপরীতে যা কিনা অস্বাভাবিক কেবল অঙ্গভঙ্গিমা আবেদনমূলক অবস্থার অভিব্যক্তি, মানব শরীরের আবির্ভাব চিত্র বর্ণনা করার মূল ভাবধারা তাঁকে অতিক্রম করে যায়। ছবিটির মূল বা প্রধান চরিত্র পুরুষ অত্যন্ত স্থির শান্তভাব সম্পন্ন। অনেক বিশেষজ্ঞদের মতে, শিল্পী তাঁর প্রতীক্ষিত ঘটনাগুলির করুন মোর সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন এই ছবিটির রচনার মধ্যে দিয়ে। ছবিটির উপরের অংশে প্রধান মূল চরিত্র পুরুষটি অর্থাৎ চিত্রশিল্পী নিজেই নিঃশব্দে এক অস্বাভাবিক অঙ্গভঙ্গিমায় হাঁটু মুড়ে বেশ শান্ত চেহারায় বসে আছেন। এই মুল চরিত্রটি চিরাচরিত কোনো অভিব্যক্তির উদ্বেগ প্রকাশ করছে না বরং এর উল্টোটা তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে তাঁর কাজ সম্পূর্ণ করে আত্মবিশ্বাসের সাথে কোন ফল ফলাফলের অপেক্ষায় রয়েছেন। তাঁর গায়ের রং হলুদ এবং কমলা আর গাঢ় লালের আন্ডারলাইন (Underline) ব্যবহার করা হয়েছে।
চরিত্রটি হাঁটু মুড়ে এমন ভাবে বসেছে যে তাঁর বাঁ হাত বাঁ পায়ের হাটুর ওপর রাখা এবং ডান হাতটি কনুই মুরে বাঁ হাতের হাতের কাঁধের কাছে আনা।
ডান হাত ও তাঁর আঙ্গুল দেখে মনে হচ্ছে শিল্পী তাঁর কাঁধে আঁচর কাটছেন। অনেকটা আমরা কোন জিনিসকে মন দিয়ে লক্ষ করার সময় গুরুত্বহীনভাবে শারীরিক কোনো অ্যাক্টিভিটি করে থাকি। এই মূল পুরুষ চরিত্রটির অর্থাৎ চিত্রশিল্পীর ঠিক নিচে এবং ছবিটির একেবারে কেন্দ্রে একটি সুন্দর মহিলাকে আঁকা হয়েছে। এটি হলো তাঁর স্ত্রী এডিথ এবং পুরুষ চরিত্রটির মত এই মহিলাটি অর্ধনগ্ন, অনাবৃত তাঁর বুক অথচ তাঁর পায়ের এবং হাতের আঙ্গুলগুল সব ঢাকা মোটা কাপড়ের ভেতর। মহিলাটির গায়ের রঙ গোলাপী, কমলা চেহারায় উদাস বা কোন আবেগের অভিব্যক্তি নেই
আর মনে হচ্ছে তাঁর সম্পূর্ণ নির্ভরশীলতা স্ব-ইচ্ছায় পুরুষ চরিত্রটির উপর সমর্পিত। তবে তাঁর চেহারায় কোন উজ্জ্বাল্য ভাব নেই, ম্লান এবং সবটাই অদৃষ্টের ওপর ফেলে রাখা। এই কারণেই হয়তো শিল্পী এই মহিলার হাত ও পায়ের দৃশ্যত অবস্থান দর্শকের সামনে সুস্পষ্ট করে তুলে ধরেননি। পুরুষ চরিত্রটির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে শিল্পী মহিলাটিকে ও অনেকটাই একইভাবে হাঁটু মুড়ে বসা অবস্থায় এঁকেছেন। ছবিটিতে মূখ্য এই দুটি চরিত্রের পর যদি কোথাও চোখ যায় তা হল মহিলাটির ঠিক নিচে তাঁর ডান পা ঘেঁষে অবস্থান করছে একটি শিশু। শিশুটি নিষ্পলকে তাকিয়ে রয়েছে ছবিটির বাঁদিকের শূন্যতায় আর তাঁর হাত দুটো দিয়ে একটি নরম বালিশ কে জাপটে ধরে রয়েছে। স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে এই বালিশটি শিশুর খুব প্রিয় বস্তু। যদিও শিশুটির সর্বাঙ্গ গরম পোশাক কিংবা কম্বলে ঢাকা শুধু তাঁর উজ্জ্বল কমল মুখ বেরিয়ে রয়েছে। শিশুটির অবস্থান এমন যেন তাঁর মা অর্থাৎ সেই মহিলা দুপাশ থেকে পা দিয়ে হাঁটু মুড়ে বসে শিশুটিকে নিরাপদ রাখার চেষ্টা করছে। মহিলাটির এইরূপ অবস্থান একটু অস্বস্তিকর মনে হতে পারে। দৃশ্যটা অনেকটা যেন মা সন্তানের জন্ম দিচ্ছেন এমন। আসল শিল্পী যখন ছবিটি তৈরি করছিলেন তখন তাঁর স্ত্রী ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন, এক্ষেত্রে শিল্পী তার সম্পূর্ণ পরিবারের এক কল্পনাকে এক বাস্তব রূপ দিচ্ছিলেন। ছবিটিতে এই তিনটি মূল চরিত্রের অভিব্যক্তি একে অপরের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা কিন্তু এই তিনজনের উৎস এবং অবস্থান এক এবং সেই পটভূমি অত্যন্ত অস্পষ্ট তবে অনুমান করে নেওয়া যেতে পারে যে পরিবারটি সোফায় বসে আছে বা কম্বল কিংবা চাদরের অনেক গোছের উপর বসে। সেখানে গাঢ় বাদামি, লাল এবং ধূসর রং এর পটভূমি হালকা সবুজ এবং নীলচে অস্পষ্ট উপাদান গুলিতে মিশে রয়েছে। 'The Family' ছবিটি সমগ্র মানবজাতির এক বুনিয়াদ পরিবার প্রথার যুক্তিভিত্তির সাক্ষ্য বহন করে।
সম্পূর্ণ পরিবারের এই ছবি কেবল ছবিতেই সীমাবদ্ধ থেকে গেল কারণ চিত্রশিল্পীর ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী এডিথ 'স্প্যানিশ ফ্লু'তে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিলেন এবং তাঁর তিনদিন পর চিত্রশিল্পী নিজেও মারা গিয়েছিলেন।
শিল্পী তার স্ত্রীর মৃত্যু শয্যায় একটি ড্রয়িং তৈরি করেছিলেন। শিল্পী ড্রইং টির নাম দিয়েছিলেন
'Edith Schiele on her deathbed', 1918, Chalk on paper. ছবিটি রয়েছে Leopold Museum, Vienna, Austria.
১৯১৮ সালের 'স্প্যানিশ ফ্লু' মহামারীতে তাঁর মৃত্যুর আগে বিখ্যাত চিত্রশিল্পী এবং তাঁর পথপ্রদর্শক বা গুরু বলে কিছু ভুল হবে না, চিত্রশিল্পী গুস্তাভ ক্লিম্টের (Gustav Klimt) এই মহামারিতে জীবন অবসান ঘটে এবং ক্লিম্টের মৃত্যুর ঠিক একদিন আগে তাঁর মৃত্যু শয্যার পাশে বসে এগন শিয়েল তাঁর গুরুর কিছু আত্মপ্রতিকৃতি ড্রইং করেছিলেন।
এই ড্রয়িংটির নাম ছিল 'Gustav Klimt on his deathbed, February, 1918,। মৃত্যুর সময় শিল্পীর বয়স হয়েছিল ৫৫ বছর। শীতের শুরুতে ক্লিম্টের একটি স্ট্রোক হয়েছিল যা তাঁকে আংশিকভাবে পঙ্গু অর্থাৎ প্যারালাইসিস (Paralysis) করে দিয়েছিল। প্রথমে তাঁকে একটি স্থানীয় স্যানেটোরিয়ামে (Sanatorium) আনা হয় এবং পরে তাঁর স্থিতিশীল অবস্থা হলে তাঁকে ভিয়েনার একটি বড় হাসপাতালে পাঠানো হয় কিন্তু মহামারীর কবলে পরায় তাঁর অবস্থার দ্রুত অবনতি হয় এবং তাঁর মৃত্যু হয়।
এগন শিয়েল ক্লিম্টের মৃত্যুশয্যায় বিভিন্ন কোণ থেকে ড্রইং গুলি করেছিলেন এবং প্রত্যেকটিতেই তাঁর চোখ বন্ধ ছিল আর মুখ আংশিক খোলা। মুখে ছিল অসংখ্য ভারী রেখা এবং ছায়াযুক্ত রেখাগুলি একদম স্থির এমনটা নয় কিন্তু এই গুলি ছিল মৃত্যুর এক অসাড় চিত্র। ক্লিম্টের চুলের কিছু
রেখা তাঁর মুখের গাঢ় জেদি রেখার সাথে মিল ছিল না আর সেইসঙ্গে চোয়ালের রেখাও তাঁর তীক্ষ্ণ কান, মুখের ভাব ব্যক্ত করার ক্ষেত্রে একটা অস্থিরতা তৈরি করে। এগন শিয়েলর এই ড্রইংগুলির অভিব্যক্তির সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল ক্লিম্টের প্রকৃত ডেথ মাস্কটির (Death Mask) অভিব্যক্তি। তাতে তাঁর মুখ শান্ত, অস্থির এক প্রশান্তির কথা বলে।
End.