১৯১৮ সালের 'স্প্যানিশ ফ্লু মহামারী' কবলে বিখ্যাত চিত্রশিল্পী ও তাঁদের শিল্পকলা:
চিত্রশিল্পী এডওয়ার্ড মঞ্চ ( Edvard munch) :
পর্ব - ২, দীপায়ন ঘোষ
এডওয়ার্ড এর জন্ম ১২ই ডিসেম্বর ১৮৬৩, অ্যাডালসব্রুক, নরওয়ে এবং মৃত্যু ২৩শে জানুয়ারি ১৯৪৪, অসলো, নরওয়ে। এডওয়ার্ড মঞ্চ ছিলেন একজন অভিব্যক্তিবাদ চিত্রশিল্পী অর্থাৎ Expressionism painter। তাঁর কাজের মধ্যে পাওয়া যায় তাঁর ব্যক্তিগত শোকাবহ ঘটনা, বিষন্নতা, বিমর্ষ গভীর আবেগের অনুবাদ, বিশৃংখল এক রহস্য দিয়ে গড়া বিভিন্ন মানুষের অভিব্যক্তি। তাঁর সবচাইতে বিখ্যাত এবং জনপ্রিয় বললে ভুল হবে না 'The Scream' নামক ছবিটি, বিশ্ব শিল্পকলার ইতিহাসে একটি অমূল্যবান সম্পদ।
The Scream Edvard Munch
এই কাজটির সমতুল্য লিওনার্দো দা ভিঞ্চির 'মোনালিসা', ভিনসেন্ট ভ্যান গগের 'দি স্টারি নাইট' এবং পাবলো পিকাসোর আঁকা 'গোর্নিকা' ছবিগুলি। এবার আসি তাঁর এমন দুটি ছবির প্রসঙ্গে যার নাম করন থেকেই স্পষ্ট হয়ে যায় বিশ্বজুড়ে 'স্প্যানিশ ফ্লু' মহামারীর হালহকিকত।
Edvard Munch (1863 1944) in his studio with canvas, in Ekely, at Skoyen, Oslo Norway, in 1943 (last photograph taken of him).
১৯১৯ সালে চিত্রশিল্পী 'স্প্যানিশ ফ্লু' মহামারীর কবলে পড়েন, সুস্বাস্থ্যের একজন ৫৬ বছর বয়সী ব্যক্তি হিসেবে এ যাত্রায় তিনি বেঁচে ওঠে কিন্তু তাঁর এই অভিজ্ঞতাটি তিনি দুটি আত্মপ্রতিকৃতি ছবির মধ্যে তুলে ধরেন। স্প্যানিশ ফ্লু আক্রান্ত হয়ে তিনি যে দুটি ছবি এঁকেছিলেন তাঁর একটি শিরোনাম ছিল 'self-portrait with the Spanish
flu', ১৯১৯ সালে, তেলরঙে ক্যানভাসের উপর আঁকা, যার মাপ ৫৯" ইঞ্চি x ৫২" ইঞ্চি এবং দ্বিতীয় ছবিটির শিরোনাম ছিল "Self-portrait after the
Spanish flu", ১৯১৯- ১৯২০ সালে,তেলরঙে ক্যানভাসের উপর আঁকা, যার মাপ ২৩" ইঞ্চি x ২৯" ইঞ্চি। এই দুটি ছবি বর্তমানে National Gallery Munch Museum Oslo
Norway তে রয়েছে।
ছবি দুটি বিষয়ে আলোচনায় যাওয়ার আগে আসুন চিত্রশিল্পীর ব্যক্তিগত জীবনের দু-চার কথা জেনেনি |শিল্পী তাঁর পাঁচ ভাই বোনের মধ্যে দ্বিতীয় সন্তান ছিলেন,১৮৬৪ সালে তাঁর পরিবারের সকলরে সাথে ওসলো শহরে জন্মস্থান ছেড়ে চিরতরের জন্য চলে আসেন। এখানে এসে তাঁর মা মারা যান চার বছর যক্ষা (Tuberculosis) রোগে আক্রান্ত হয়ে এবং এর সাথেই শুরু হয় তাঁর পরিবারে একের পর এক শোক যাত্রা। এরপর তাঁর বোন সোফি ও ১৮৭৭ সালে যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান,তখন তাঁর বোনের ১৪ বছর বয়স ছিল।

পরবর্তী সময়ে শিল্পী 'The Sick Child' নামক একটি ছবি এঁকেছিলেন (১৮৮৫-১৮৮৬ সালে) তাঁর বোনের এই অসুস্থতার ওপর। তাঁর আরও এক বোন জীবনের বেশিরভাগ অবস্থা মানসিক অবসাদ নিয়ে কাটিয়ে দিয়েছিল। এরপর তাঁর একমাত্র ভাই ৩০ বছর বয়সে এই 'স্প্যানিশ ফ্লু' এর কারণে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। চিত্রশিল্পী, এডওয়ার্ড মঞ্চ তাঁর ডায়েরিতে লিখেছেন, "Illness, insanity and death
where the black angels that kept watch over my cradle and accompanied all my
life ".অর্থাৎ "অসুস্থতা, মানসিক উন্মাদনা এবং মৃত্যুর কালো অন্ধকারের স্বর্গদূতরা আমার শৈশবাবস্থাকে নজরবন্দি করেছিল এবং আমার সাথে থেকে গিয়েছিল"।
আসুন এবার শিল্পীর মূল ছবি দুটিকে নিয়ে আলোচনা করি: প্রথমে তাঁর প্রথম ছবিটি 'স্পেনীয় ফ্লুতে স্ব-প্রতিকৃতি'
('Self-portrait with the Spanish flu')

ছবিটিতে, শিল্পী বিচ্ছিন্ন এবং একা নিজের ঘরে একটি উইকার চেয়ারে ভারী অসুস্থ পোশাকে এবং কম্বল জড়িয়ে বসে আছেন। ভারী পোশাকে থাকা সত্ত্বেও স্পষ্টতই তাঁর ভগ্ন শারীরিক অবস্থা বোঝা যাচ্ছে। তাঁর চেহারায় কোন উজ্জ্বলতা নেই, বিবর্ণ, ফ্যাকাশে এবং অনুমান করা হয়েছিল তাঁর জন্ডিস হয়েছিল তবে এ বিষয়ে কোনো ভরসা যোগ্য তথ্য পাওয়া যায়নি। তাঁর চুল হালকা এবং পাতলা দেখাচ্ছিলো এবং এমন পলকহীন চোখে দর্শকের দিকে শিল্পী তাকিয়ে আছেন যেন দর্শককে তিনি তাঁর কষ্টের কথা, অসুবিধার কথা, অসুস্থতার কথা জানান দিচ্ছেন। তাঁর মুখ খোলা বা হা করা হয়তো, রোগের কারণে তাঁর স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাসে অসুবিধা হচ্ছে কিংবা অসুস্থতার কারণে অস্থিরতা বা প্রলাপ বলেছেন। তিনি একটি ঘরে সম্পূর্ণ একা, আইসোলেশনে রয়েছেন যদিও এই নিঃসঙ্গতা তাঁর জীবনে ও ছবির একটি বৈশিষ্ট্য। ভাবতেও অবাক লাগে এত অসুস্থতার মধ্যেও তিনি এই ছবিটি তৈরি করেছিলেন। আসুন এবার ছবিটির বাকি অংশগুলির দিকে একটু চোখ ফেরাই যেমন, দেওয়াল ও তাঁর রঙ, শিল্পী চেয়ারের পাশে বা পেছনে রাখা বিছানার এক অংশ, ঘরটির মেঝে ও ইত্যাদিতে বেশ উজ্জ্বল রঙের ব্যবহার যা কিনা একটি ইতিবাচক অথবা আশাবাদী দিকে তুলে ধরছে আর ওই উজ্জল্যতা শিল্পীর চেহারায় যথেষ্ট পরিমাণে প্রতিফলিত হচ্ছে। মহামারীর উদ্বিগ্ন নিরাশাকে খুব সহজেই ছবির এই নিজস্ব আলো নষ্ট করে দিচ্ছে। তবে এটা বলা খুব কঠিন যে, এই রঙের ব্যবহার শিল্পীর কতটা কল্পনার বা কতটা বাস্তবের সাথে জড়িত। ঠিক একইভাবে ছবিতে ঘরের মেঝেটি যথেষ্ট রঙিন, সম্ভবত এই রং কোনো রঙিন গালিচার।চেয়ার এর পেছনের দিকে সম্ভবত একটি দরজা খোলা অবস্থায় তবে দরজাটি কোন বাইরে যাবার নয় বরং অন্য একটি ঘরের, যেখানে তুলনামূলকভাবে আলো অনেক কম যা কিনা শিল্পীর মনের গভীর অবসাদকে রহস্যজনকভাবে ব্যক্ত করে।
দ্বিতীয় ছবিটির নাম 'স্প্যানিশ ফ্লুর পরে স্ব- প্রতিকৃতি'( 'Self-portrait after the Spanish
flu'),নামকরণ থেকে আবারো স্পষ্ট হয়ে যায় শিল্পী সুস্থতার দিকে ক্রমশ এগিয়ে চলেছেন। এই 'স্প্যানিশ ফ্লু' তাঁর শারীরিক যতটা ক্ষতি করার করে দিয়েছে। তাঁর এই দ্বিতীয় ছবিটিতে শিল্পী উঠে দাঁড়িয়েছেন, এই সময়ে তাঁর ছবিতে আর কোন উকার চেয়ার
নেই। ছবিটিতে এমন ভাবে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন কিছুটা ঝুঁকে মুখটা এগিয়ে মনে হচ্ছে তিনি কোন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চেহারা পর্যবেক্ষণ করছেন,এই অসুস্থতার মুখে বা চেহারায় কিরূপ প্রভাব ফেলেছে। মজার বিষয় হলো ছবির কম্পোজিশন বা গঠন এমনই যে শিল্পী আয়নায় না তাকিয়ে সরাসরি দর্শকের চেহারায় তাঁর অবস্থার প্রতিফলন দেখতে চাইছেন, তাঁর এমনভাবে ঝুকে দাঁড়ানো স্পষ্ট করছে শারীরিক দুর্বলতা কাটেনি, তাঁর মুখের ভাব এখনো ক্লান্তির আর বিষন্নতায় ভরা চোখ, যার রং গাঢ়, মুখে রয়েছে অনেক ভাঁজ তবে আগের ছবির মত ফ্যাকাশে বা বিবর্ন নয়। উজ্জ্বল রং এর ব্যবহার তাঁর চেহারায় অসুস্থতার অবশিষ্ট অংশগুলিকে একপ্রকার অস্বীকার করে। তাঁর ডুবে যাওয়া ভারী চোখ দুটো এখন স্পষ্ট ও উজ্জ্বল, গাঢ় ও দৃঢ়ভাবে দৃষ্টি সুনিশ্চিত করছে। তাঁর মুখের ঘন দাড়ি ও বড় বড় চুল home Quarantine এবং isolation জীবনকে ইঙ্গিত করছে। তাঁর ঘরটি আগের ছবির মতো উজ্জ্বল আলোয় ভরে গিয়েছে। গালিচার রং এবং টেবিলের বইগুলো স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসার সূচনা করে দিচ্ছে। তাঁর পোশাক বদলে ফরমাল পোশাক হয়েছে, হয়তো তিনি তাঁর সুস্থতার ভাবকে পুষ্ট করতেই এই পোশাক কিংবা শিল্পীকে নিজের কোন কাজের জন্য বাইরে যেতে হবে।
প্রসঙ্গত শিল্পীর 'অভ্যন্তরীণ অশান্তিতে স্বপ্রতিকৃতি'(Self-portrait in inner turmoil) শীর্ষক ১৯২০ সালের একটি ছবিতে নিজেকে নিদ্রাহীন এবং উত্তেজিত দেখায়। তাঁর নিদ্রাহীনতা নিয়ে তিনি নিকট বন্ধুদেরকে অভিযোগ করেছিলেন এবং তাঁর এই অবস্থার জন্য তিনি পূর্বের 'স্প্যানিশ ফ্লু' কে দায়ী করেছিলেন।
No comments:
Post a Comment