শিল্পের অন্যকথারা' পর্ব - ৩ সৌরভ চট্টোপাধ্যায়
সমকালীন ভারতীয় চিত্রশিল্পী ফ্রান্স থেকে।
১০ টা প্রশ্নের উত্তরে শিল্পী সৌরভ চট্টোপাধ্যায়
১. সমকালীন শিল্পীদের গ্রুপে বা সমষ্টিগত ভাবে শিল্পচর্চায় সুবিধা না অসুবিধা ?
সৌরভ চট্টোপাধ্যায়
উত্তর : যে যেরকম ভাবে অভ্যস্ত, আমি তো আমার স্টুডিওতে একটা বেড়াল ছানা থাকলেও কাজ করতে পারিনা। আবার অনেকে দেখি একটাই স্টুডিওতে ৫ জন কাজ করছে। এটা সম্পূর্ণ একটা মানসিক ব্যাপার।
২. শিল্পীরা কেন শিল্পের commercial aspect কে ignore করে থাকেন ? অথচ ছবি বিক্রির বিষয়টি কে কোন প্রদর্শনীর সাফল্যের মূল মানদণ্ড হিসেবে দেখে থাকেন ?
সৌরভ চট্টোপাধ্যায়
উত্তর : শিল্পীরা বিশেষতঃ একটা শিল্প ভাবনার মধ্যে ডুবে থাকেন, যখন ই Commercial aspect এর কথা ভাবতে হয় তখন সেই শিল্প ভাবনার ছন্দপতন হয়। এই দুটো আলাদা ভাবনা এক সঙ্গে চালিত করা সাধারণত শিল্পীরা পারেনা। সে ক্ষেত্রে একজন কমার্শিয়াল এডভাইজার সাহায্য নিতে হয় এবং সেটা অনেক সময় ব্যায়বহুল হয়ে পরে বা ছবি বিক্রি হলে তার শতাংশ দিয়ে থাকে। আমার জানা নেই যে ছবি বিক্রিকেই শিল্পীরা সাফল্যের মানদণ্ড হিসেবে দেখেন কিনা। বরঞ্চ শিল্প যদি উৎকৃষ্ট মানের এবং অনুপ্রেরণাদায়ক হয় শিল্পীরা তাকেই সফল শিল্প হিসেবে দ্যাখে। তবে একথা ঠিক গ্যালারি যদি দ্যাখে কোনো শিল্পীর শিল্প বিক্রি হচ্ছে তাকে প্রাধান্য দেয়। সব সময় যে বিক্রয় যোগ্য শিল্পই যে উৎকৃষ্ট বা সফল তার কোনো মানে নেই। ধরা যাক কেও গনেশ এঁকে গাদা গাদা বিক্রি করছে তাহলে কি সেই শিল্পী সাফল্য পেয়েছে ?
৩. বাংলা শিল্পীরা কেন প্রচারমুখী হন না এবং প্রচার বিমুখ হওয়াটাকে খুব গর্বের বিষয় বলে থাকেন ?
সৌরভ চট্টোপাধ্যায়
উত্তর : এর নানা রকম কারণ আছে।
( ক ) আধুনিক শিল্পীদের চিত্রকলার সাথে সাথে আরো কিছু তৈরী করতে হয়, যেমন চিত্রকলার বিশ্লেষণ, বৌদ্ধিকতা, মুখোমুখি আলোচনার ক্ষমতা, সারা বিশ্বের আধুনিক শিল্পের গতি প্রকৃতির খবর রাখা এই সব। বাংলার শিল্পীরা এইগুলি করতে অপারগ হয়ে থাকেন বিভিন্ন কারণে তার ফলে একটা হীনমন্যতার জন্ম নেয় এবং নিজে থেকে এগিয়ে প্রচার করতে চান না।
(খ) অর্থনৈতিক কারণে শিল্পীরা খুব নিম্নমানের মাধ্যমে কাজ করে থাকেন, তাতে মনের আনন্দে অনেক কাজ করা হয় বটে কিন্তু সেগুলি নিয়ে এগোনোর কথা ভাবতে পারেন না। কারণ কোন ভালো জায়গায় দেখতে গেলে শিল্পের মানের সাথে মাধ্যম গুলিও দেখা হয়।
(গ) একজন সফল শিল্পীর কাজের মধ্যে অবশ্যই জোর থাকে। নিজের কাজে সেই জোরের অভাব সাধারণ শিল্পীরা বোধ করে থাকেন তার ফলে আর এগোতে চান না।
(ঘ) জীবনের শুরুতে হয়তো দু একবার গ্যালারিতে গিয়ে কাজ দেখানোর চেষ্টা করেছেন এবং গ্যালারি ফিরিয়ে দিয়েছে সেই হীনমন্যতা থেকে প্রচারবিমুখ হয়েপড়েন।
(ঙ) অনেক সময় নিজের কাজ নিয়ে নিজেই উচ্চধারণা বা superiority complex আছে তাতে ভয় পান কেও যদি তাঁর শিল্পের অবমাননা করেন। এবং উল্টে গর্বিত ভাব দেখান যে তিনি কাউকে পাত্তা দেন না।
৪. বাংলা সফল হওয়া শিল্পীদের ব্যক্তিগত আর্ট গ্যালারি নেই কেন ?
সৌরভ চট্টোপাধ্যায়
উত্তর : বাংলার সংস্কৃতির মধ্যে শিল্পকলার কদর এবং রসাস্বাদন হয়নি, বাংলায় শিল্পকলা ব্রাত্য থেকে গেছে। তখনই একটা প্রয়াশ এর সার্থকতা যেখানে একটা মানে আছে। একটা ব্যক্তিগত প্রদর্শশালা বা জাদুঘর যদি খোলা হয় তার দু মাস পরেই অবহেলায় তা পোড়োবাড়িতে পরিণত হবে। তাছাড়া সে সব ব্যায় ভার কে চালাবে ? আর্ট গ্যালারি মানেই কিছু লোকের মাস মাহিনার ব্যবস্থা করা। যেখান থেকে কোনো লাভ হয়না সে সব জিনিস সরকার ও চালায় না। মধ্যবিত্তরা যদি শিল্পের কদর করতো তাহলে এত দুর্দশা হতোনা। ইউরোপে দেখি খুব সাধারণ লোকেরাও ছবি কেনে এবং প্রদর্শনী দেখে, এই চর্চা টা আমাদেরও দরকার।
৫. ভাড়া নেওয়া আর্ট গ্যালারি গুলিতে শিল্পীরা প্রদর্শনী করলে সেখানে টিকিটের ব্যবস্থা কেন করা হয় না ?
সৌরভ চট্টোপাধ্যায়
উত্তর : শিল্পীর গ্যালারি ভাড়া নিয়ে প্রদর্শনী করাটা একটা ইনভেস্টমেন্ট, যেটা ক্রমাগত করতে করতে পরিচিতি বাড়ে, বায়োডেটাও লম্বা হয় এবং ভবিষ্যতে কাজে দেয়। এখানে যে প্রদশনী দেখতে আসছে তার থেকেও যে প্রদর্শনী করছে তার আগ্রহ বেশি। পরিচিতি বাড়ার সাথে সাথে শিল্পীর ছবি বিক্রির সম্ভাবনাও বেড়ে যায় এবং শিল্পীর সেখান থেকেই আর্থিক লাভ হয়।
তাছাড়া শিল্পকলার মান বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই খুব নিম্নমানের হয় তার ফলে মানুষ এমনিতেই দেখতে যায় না, এরপর টিকিটের ব্যবস্থা হলে কেও যাবেনা। ধরা যাক ফ্রান্সিস বেকনের একটা শো চলছে সেখানে মানুষ টিকিট কেটে ঢুকবে, কারণ মানুষ জানে টিকিট কাটার একটা অর্থ আছে।
৬. শিল্পকলার বিষয়ে সাধারণ মানুষ উদাসীন আচরণ করে থাকে কেন? এর দায় কার ?
সৌরভ চট্টোপাধ্যায়
উত্তর : যেহেতু আমি মধ্যবিত্ত পরিবারে মানুষ তাই এর উত্তরটা খুব সহজ। "যারা কিছু পারেনা তারাই শিল্পী হয়" এটা আর্ট কলেজে ঢোকার সময় শুনতে হয়েছিল এক নিকটাত্মীয়ের কাছে। আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে কি করে অর্থ উপার্জন করা যায় এটাই একমাত্র লক্ষ্য। এটাই উত্তরসুরির মধ্যে গেঁথে দেওয়া হয়। বিদ্যালয় গুলিতে শিল্প বিষয়ক কোনো আলোচনা বা ক্লাস নেওয়া হয়না তার ফলে শিল্পের সাথে এক দূরত্ব তৈরী হয় এবং মানুষ উদাসীন হয়ে বলে " আমি তো আর্টের কিছু বুঝিনা " । এর দায় আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা, একটা দেশ তখনই উন্নত দেশ বলা হয় যেখানে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, অর্থর পাশাপাশি শিল্প সাহিত্যেরও মূল্যায়ন করা হয়। আমাদের দেশে তখনই শিল্পের মূল্যায়ন হবে যখন একজন শিল্পীর আয় একজন ডাক্তার এর সমতুল্য হবে।
৭. শিশুদের শিল্প শিক্ষক হওয়ার জন্য কোন যোগ্যতার মাপকাঠি নেই কেন ?
সৌরভ চট্টোপাধ্যায়
উত্তর : প্রথম কথা হলো একজন প্রশিক্ষিত শিল্পী আর্ট কলেজ থেকে বেরিয়ে সব সময় চেষ্টা করে সাফল্যের মুখ দেখতে, সে অর্থনৈতিক হোক বা পরিচিতি। শিশুদের অভিভাবক প্রশিক্ষণের জন্যে নাম মাত্র মূল্য দিয়ে থাকে, তাও বহুবার আবেদন নিবেদন করতে হয় সেটা পাওয়ার জন্যে। কিসের আশায় একজন যোগ্য শিল্পী এই কাজ করবে ? একমাত্র যদি স্কুল গুলি অধিক মাসহারা দিয়ে যোগ্য শিল্পী বা শিক্ষক নিয়োগ করে তবেই তা সম্ভব হয়। এখানেও সেই মধ্যবিত্ত মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়, মানুষ একজন অংকের বা বিজ্ঞানের শিক্ষক এর জন্যে যতটা সন্মান দেয় একজন শিল্প শিক্ষক কে দেয়না কারণ তার কাছে শিল্প জিনিষটা অর্থহীন। তার ফলে কোনো রকমে পাড়ার শঙ্কুদা গোছের গলায় সরু নকল সোনার চেন পড়া, ঘাড়ে গলায় পাউডার মাখা কাউকে একটা দিয়েই কাজ চালিয়ে নেয়।
৮. Professional Artist বলতে কী বোঝায় ?
সৌরভ চট্টোপাধ্যায়
উত্তর : প্রশ্নটার মধ্যেই এর উত্তর আছে। যিনি তার নিজের শিল্পকেই profession করে থাকেন। অর্থাৎ ওনার জীবিকা শিল্প থেকেই উঠে আসে। কারো যদি রুজি রুটির জন্যে অন্য কাজ করে সপ্তাহে একদিন শিল্প করতে হয় সে ক্ষেত্রে তিনি sanday painter হয়ে যাবেন। শিল্প এমনি একটা জিনিস যেটার মধ্যে সবসময় থাকতে হয় তবেই সফল শিল্প করা সম্ভব। প্রশ্নটা যদি হতো prafessonal Artist হতে গেলে কি করা উচিত তাহলে উত্তরটা অন্য রকম হতো।
৯. আজকের সময় বাংলা তথা ভারতবর্ষের যদি Pablo Picasso, Jackson Pollock , Mark rothko, Willem de kooning, Jean-Michel Basquiat, প্রমূখ বিখ্যাত শিল্পীরা যদি জন্মাতেন তারা কি একই ভাবে সাফল্য পেতেন ?
সৌরভ চট্টোপাধ্যায়
উত্তর : ইউরোপের শিল্পীরা যে পরিমান সাফল্যের আলো দেখে তা ভারতবর্ষের শিল্পীরা পায়না। আমাদের দেশের রামকিঙ্কর, সোমনাথ হোড়, গনেশ পাইন এনারা কি কোনো অংশে কম ? কিন্তু এদের কথা কেও জানেনা। বিশ্বে যে দেশগুলি ছড়ি ঘোরায় তাদেরই সফলতার কথা শোনা যায়। না, Pablo Picasso, Jackson Pollock , Mark rothko, Willem de kooning, Jean-Michel Basquiat প্রমূখ বিখ্যাত শিল্পীরা যদি জন্মাতেন ভারতবর্ষে তাহলে তারা একই ভাবে সাফল্য পেতেন না। অন্তত ভারতবর্ষের নাগরিক হয়ে পেতেন না। আজ আনিশ কাপুরের যা খ্যাতি তা ওই আমেরিকাবাসি বলেই সম্ভব। দেশে থেকেও হয়তো সম্ভব যেমন ভাবে রবীন্দ্রনাথ এর জগৎ জোড়া খ্যাতি। নোবেল প্রাইজ না পেলে হয়তো এটা সম্ভব হতোনা। তাও বলবো রবীন্দ্রনাথ এর নাম খুব কম লোকেই বাইরের দেশে শুনেছে এক রীতিমতো সংস্কৃতিবান মানুষ ছাড়া।
১০. কত শতাংশ বাংলা কিংবা ভারতের শিল্পীরা অভিনব, মৌলিক, সম্পূর্ণ নতুন ধরনের শিল্পকে বোঝার মত ক্ষমতা রাখে ?
সৌরভ চট্টোপাধ্যায়
উত্তর : আমাদের আর্ট কলেজ গুলিতে শিক্ষার মান খুব নিম্নমানের, সম্প্রতি কয়েকজন খোলা মনের শিক্ষক অনেকটা পরিবর্তন এনেছেন কলেজ গুলিতে। এর ফলে শিল্পীদের নিজেদের ই স্বশিক্ষিত হতে হয়। এই মুহূর্তে বলতে পারি সত্যি খুব ভালো কাজ হচ্ছে ভারতে এবং বাংলায়। অনেক নতুন চিন্তা ভাবনা নিয়ে কাজ হচ্ছে। আমি এখন ফ্রান্স এ আছি এবং দেখছিও এরা কোথায় একটা থেমে গেছে। ভালো কাজ এখানে প্রায় চোখেই পড়েনা। সেই তুলনায় আমাদের বাংলায় অসাধারণ সব অভিনব, মৌলিক, সম্পূর্ণ নতুন ধরনের কাজ দেখতে পাচ্ছি।
No comments:
Post a Comment